শনিবার, ০৫ অক্টোবর, ২০২৪, ২০ আশ্বিন ১৪৩১
ঈদে খাবার টেবিলে থাকে মজার মজার খাবার। অনেকেই স্বাভাবিকের চেয়ে খানিকটা বেশিই খেয়ে ফেলেন। তাই অনেক সময় দেখা দেয় নানা ধরনের শারীরিক সমস্যা। ফলে অনেকেই অতিরিক্ত খেয়ে ফেলেন। এই অতিরিক্ত খাবার খাওয়াই ডেকে আনে নানা সমস্যা।
ঈদ মানেই সেমাই-পায়েসের মতো বিভিন্ন মিষ্টি। মিষ্টান্নর পাশাপাশি চলে বিভিন্ন পদের মাংস। আর এর মধ্যে মুরগির নানা পদসহ গরু, খাসি ও মহিষসহ বিভিন্ন ধরনের লাল মাংসের পদ বেশি প্রাধান্য পায়। লাল মাংস পছন্দ করেন না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। এই লাল মাংস একটানা দীর্ঘদিন গ্রহণে ও অতিভোজনে শরীরের নানা রোগবালাই বাসা বাঁধতে পারে। প্রতিদিন একজন সুস্থ ব্যক্তি কতটুকু প্রোটিন খাবেন সেটা নির্ভর করে ওই ব্যক্তির আদর্শ ওজনের ওপরে।
কারোরই দিনে ৭০ গ্রামের বেশি মাংস খাওয়া উচিত নয়। গরুর মাংস খাওয়ার নিরাপদ মাত্রা হলো সপ্তাহে দুদিন বা সপ্তাহে মোট তিন থেকে পাঁচ বেলা। প্রতি বেলায় ঘরে রান্না করা মাংস ২-৩ টুকরার বেশি খাবেন না।
দীর্ঘ সময় ধরে প্রতিদিন একটানা ১০০ গ্রামের বেশি লাল মাংস খেলে হৃদরোগে মৃত্যুর আশঙ্কা, ব্রেন স্ট্রোকের ঝুঁকি, বৃহদন্ত্র ও প্রস্টেট ক্যান্সারের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। এ ছাড়া অতিরিক্ত লাল মাংস গ্রহণে কোষ্ঠকাঠিন্য, রক্তের চর্বি বেড়ে যাওয়া ও গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা হয়। লাল মাংস থাকা বিশেষ ইনফ্লামেটরি যৌগ পাকস্থলী, ক্ষুদ্রান্ত্র ও বৃহদন্ত্র ক্যান্সারের জন্যও দায়ী। এ ছাড়া ফুসফুস নানা রোগে আক্রান্ত হওয়া, কোলন ও স্তন্য ক্যান্সারে ভূমিকা রাখে। এমনকি অতিরিক্ত লাল মাংস গ্রহণে আর্থ্রাইটিস, গাউট, পেপটিক আলসার, পিত্তথলিতে পাথর, প্যানক্রিয়াস প্রদাহ ও কিডনি রোগসহ বিভিন্ন জটিলতা তৈরি করে। টাটকা লাল মাংসের চেয়ে প্রক্রিয়াজাতকৃত লাল মাংস আরো বেশি ক্ষতিকারক।
শরীর সুস্থ-সবল রাখার অন্যতম শর্ত হচ্ছে প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে সুষম খাবার গ্রহণ করা। খাদ্যের একটি বা একটি পুষ্টি উপাদানসমৃদ্ধ খাবার অতিরিক্ত গ্রহণ না করে ৬টি উপাদানসমৃদ্ধ খাবার তালিকায় রাখা। প্রতি মুহূর্তে শরীরের যেসব কোষ ক্ষয় হচ্ছে তা পুনর্গঠনের জন্য প্রয়োজন যথাযথ পুষ্টি। সে জন্য পুষ্টির সব উপাদান থেকে সঠিক পরিমাণে খাবার গ্রহণ করতে হবে।
মাংস শুধু যে ক্ষতিকর তা নয়, এ থেকে প্রোটিন, ভিটামিন-(বি১, বি৩, বি৬ ও বি১২), জিংক, সেলেনিয়াম, ফসফরাস ও আয়রন ভালো পরিমাণে পাওয়া যায়। এই পুষ্টি উপাদানগুলোর স্বাস্থ্যগত উপকারিতাও অনেক।
সব খাবার থেকে উপকার পেতে হলে অবশ্যই রান্না করার ক্ষেত্রে, খাবার নির্বাচন করার ক্ষেত্রে ও পরিমাণ কতটুকু হবে সে বিষয়ে কিছু নিয়ম মানা জরুরি। যেমন—
- মাংস রান্নায় দৃশ্যমান জমানো চর্বি বাদ দিয়ে রান্না করতে হবে। রান্না করতে হবে কম তেলে।
- মাংস রান্নার আগে সম্ভব হলে ৫-১০ মিনিট সিদ্ধ করে পানি ঝরিয়ে নিলে চর্বির অংশ অনেকটা কমে যায়। উচ্চ তাপে রান্না করতে হবে।
- মাংস রান্নার সময় ভিনেগার, টক দই, পেঁপে বাটা ও লেবুর রস ইত্যাদি ব্যবহার করতে পারেন এতে চর্বির ক্ষতিকর প্রভাব কিছুটা হলেও কমানো সম্ভব।
- যাঁদের উচ্চ রক্তচাপজনিত সমস্যা আছে বা কো-মরবিডিটি আছে তাঁরা একেবারেই না এড়াতে পারলে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে দু-এক টুকরা খেতে পারেন, সে ক্ষেত্রে মাংস রান্নায় সবজি ব্যবহার করতে হবে, যেমন—কাঁচা পেঁপে, লাউ, চালকুমড়া, টমেটো কিংবা মাশরুম। কিংবা তাঁরা মাংসের সঙ্গে সবজি মিশিয়ে কাটলেট বা চপ করে খেতে পারেন।
- একবারে ভূঁরিভোজ না করে সারা দিনে অল্প অল্প করে বারবার খাওয়া উচিত।
- গুরুপাক খাবারের সঙ্গে শসা, লেবু, টমেটো ইত্যাদির সালাদ রাখা যেতে পারে।
- তিনবেলা ভারী খাবার না খেয়ে যেকোনো একবেলা হালকা খাবার, যেমন—সবজির স্যুপ, সবজি ও রুটি রাখতে পারেন। হপ্রত্যেক প্রধান খাবারের ২০ থেকে ৩০ মিনিট আগে কুসুম গরম পানি পান করতে পারেন, যা বিপাকক্রিয়ার হার বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
- খাবার কিছু সময় পর তালিকায় লেবু পানি বা টক দই রাখলেও তা হজমপ্রক্রিয়া বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
- ঈদে আমরা অনেকে নানা সোডা পানি বা সফট ড্রিংকস পান করি। এগুলোর পরিবর্তে চিনি ছাড়া নানা মৌসুমি ফলের জুস, বোরহানি গ্রহণ উত্তম ।
- ঈদের দিন অবশ্যই মধ্যসকাল বা বিকেলের নাশতায় টকজাতীয় মৌসুমি ফল রাখতে হবে, যা রোগ প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করবে।
- পানীয় হিসেবে ডিটক্স ওয়াটার ঈদের এই সময় খুব কার্যকর ভূমিকা পালন করবে।
- মাংস খাওয়ার সময় ঝোল বাদে খাওয়া ভালো। আবার ভুনা মাংসের পরিবর্তে কম তেলে গ্রিল, বারবিকিউ করে বা কাবাব করেও মাংস খাওয়া যায়।
- অসম্পৃক্ত উদ্ভিজ্জ তেল ব্যবহার করুন রান্নায়। ঘিয়ের ব্যবহার বাদ দিয়ে দিন একেবারে। ঘ্রাণটুকু রাখতে একেবারে শেষে সামান্য একটুখানি ঘি ওপরে ছড়িয়ে দিতে পারেন। ঘিয়ে ভাজা পরোটার পরিবর্তে সেঁকা রুটি খেতে পারেন।
- ঈদে বাড়িতে নানা রকম খাবার থাকে, তাই বাইরের সব খাবার এড়িয়ে চলুন।
- ঈদে তুলনামূলক বেশি খাওয়া হয়, সে জন্য অবশ্যই সকালে-বিকেলে ব্যায়াম করে বা হেঁটে অতিরিক্ত ক্যালরি বার্ন করার চেষ্টা করুন।
ঈদের সকালের খাবার
ঈদের সকালের নাশতায় রুটির পাশাপাশি থাকতে পারে হালকা তেলে ভাজা পরোটা বা সবজির নরম খিচুড়ি। তার সঙ্গে মুরগির তরকারি বা ডিম ভুনা রাখা যায়। তবে সকালের খাবারকে স্বাস্থ্যকর বানাতে একটা সবজি রাখতে হবে অবশ্যই। সব শেষে মিষ্টি খাবারে থাকতে পারে স্বল্প মিষ্টিযুক্ত সেমাই, পায়েস, ফিরনি, পুডিং ইত্যাদি।
মধ্যসকাল ও বিকেলের নাশতা
ঈদের দিনে অনেকে সকাল ও দুপুর, দুপুর ও রাতের মাঝের সময়টাতে হালকা কিছু খান। সে ক্ষেত্রে ফুচকা ছাড়া বা অল্প ফুচকা দেওয়া চটপটি খেতে পারেন। যেহেতু এখন বেশ গরম, তাই এ সময়ের সব থেকে পুষ্টিকর খাবার হলো তাজা ফল বা ফলের সালাদ। এ ছাড়া ফলের জুস, বেলের শরবত, ডাবের পানি খাওয়া যেতে পারে, তাতে শরীরে পানিস্বল্পতা তৈরি হবে না। আবার চিকেন ভেজিটেবল স্যুপ, স্টু জাতীয় খাবারও রাখা যায়।
দুপুরের খাবার
ঈদের দিনে দুপুরের খাবারে খুব হালকা তেলের পোলাউ বা খিচুড়ি খাওয়া যাবে। সবচেয়ে ভালো হয় পোলাউ বা খিচুড়িতে সবজির ব্যবহার থাকলে। এই গরমে ডুবো তেলে ভাজা বা অতিরিক্ত মসলাদার খাবার খাওয়া এড়িয়ে চলা উচিত। লাল মাংসের পরিবর্তে বেক করা কাবাব বা গ্রিল করা মুরগি ভালো খাবার হবে। ঈদের দিনে সুস্থ থাকতে রান্নার কৌশলের পরিবর্তনের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। রান্না পদ্ধতির কিছুটা পরিবর্তনের মাধ্যমে যেকোনো মজাদার খাবারই খাওয়া যায়। মাছ বা মাংস ডুবো তেলে না ভেজে স্বাস্থ্যকর উপায়ে এয়ারফ্রায়ারে তেল ছাড়া ভেজে খেতে পারেন। এ ছাড়া দুপুরের অন্য খাবারের পাশাপাশি কম তেল মসলার চায়নিজ সবজি ও সালাদ খুবই স্বাস্থ্যকর পদ। রান্না করা যেতে পারে সবজির কোর্মাও। কোমল পানীয়ের বদলে বোরহানি বা মাঠা খাওয়াই উত্তম, খাবারের পর রাখতে হবে টক দই।
রাতের খাবার
কেউ যদি মনে করেন, রাতে ভালো খাবার খাবেন, সে ক্ষেত্রে মাছ বা মাংসের ভিন্নধর্মী রান্নার সঙ্গে ভাত খেলে মেন্যুটা অনেক বেশি স্বাস্থ্যকর হবে। ঈদের রাতে দাওয়াতে গেলেও ভালো খাবার, আবার বাড়িতে থাকলেও ভালো খাবার। তাই রাতের খাবারের মেন্যু একটু ভিন্নভাবে করলে ভালো। মাংসের একটি স্বাস্থ্যকর পদ বা বাসায় থাকলে মাছের একটি পদ হতে পারে আদর্শ খাবার। সঙ্গে একটি পদ সবজি রাখতে পারেন।