শনিবার, ০৫ অক্টোবর, ২০২৪, ২০ আশ্বিন ১৪৩১
কুসংস্কার
দু’শো বছরের ইংরেজ শাসনের নির্মম অভিজ্ঞতা না থাকলে বাংলার মুসলমানদের নিকট অতীতের ইতিহাস এতটা মর্মান্তিক হত না, আরো গৌরবোজ্জ্বল হত। ইংরেজ আমলে বাংলার মুসলমানদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থা এতটা শোচ্য হয়ে পড়েছিল যে, তাদের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাদীক্ষার বিলুপ্তিতে ধর্মীয় অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় হয়ে পড়েছিল। বহু মুসলিম এলাকায় মসজিদ ছিল না, অনেকে সালাত আদায় করতে জানত না, মুসলিমদের দু’বেলা অন্ন জোগাড়ের জন্য হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে হত। তাই রমাদানে রোযা পালনকারী মুসলিমের সংখ্যা কম ছিল। অনেক কৃষক রোযা রেখে চাষাবাদ করতো, তারা জগে করে পানি নিয়ে যেতো, তৃষ্ণা লাগলে একটি চোঙায় ফু দিয়ে রোযা জমা রেখে পানি পান করত, আবার চোঙায় মুখ লাগিয়ে রোযা টেনে নিত। অবাক মনে হলেও এটিই ছিল বাস্তবতা। এমন দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থার মূল কারণ ছিল চরম দারিদ্র ও ততোধিক চরম অশিক্ষা।
সংস্কার
ধীরে ধীরে অবস্থার পরিবর্তন হয়। ভারতের অন্য অঞ্চলের ন্যায় বাংলায়ও সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়। যাদের সামান্য পরিমাণ ধর্মীয় জ্ঞান ও চেতনা ছিল, তারাই সংস্কারের চেতনা অনুভব করতেন। কিন্তু পথের দিশা পেতেন না। এক্ষেত্রে পথ দেখাল আরেকটি পথযাত্রা: হাজ্জের সফর। কেউ স্বীকার করুক বা না করুক, অষ্টাদশ শতকে এশিয়া ও আফ্রিকায় যেসব সংস্কার আন্দোলনের উদ্ভব হয়েছে সেগুলোর অধিকাংশই প্রেরণা লাভ করেছে মুহাম্মাদ ইবন আবদুল ওয়াহহাবের সংস্কার আন্দোলন হতে এবং এর সাথে তারা পরিচিত হয়েছেন হাজ্জের সফরে।
তবে সেকালের স্বল্পজ্ঞানী সংস্কারকবৃন্দ যে প্রজ্ঞা দেখিয়েছিলেন, আধুনিক যুগের অনেক মহাজ্ঞানী শুয়ুখের কাছে তা পাওয়া যায় না। এশিয়া ও আফ্রিকার সংস্কারকদের কর্মপন্থা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তারা মাক্কায় অর্জিত সংস্কারের জ্ঞান, পরিধি, চেতনা ও পদ্ধতিকে স্থানীয় চাহিদা ও প্রয়োজনের আলোকে অভিযোজিত করেছেন। যেমনটি দেখা যায়, হাজি শরিয়াতুল্লাহ-এর সংস্কার আন্দোলনের ক্ষেত্রে। দেখা যায়, আরব শায়খদের রচিত কোন কিতাবের আলোকে তিনি সংস্কার কাজ চালাননি। বরং স্থানীয় বাস্তবতার আলোকে দফাভিত্তিক সংস্কার করেছেন। ফলে স্থানীয় জনগণ তাঁর আহবানে বিপুলভাবে সাড়া দিয়েছে। বৃহত্তর ফরিদপুর ও বরিশাল অঞ্চসহল সারাদেশে ইসলামের মৌলিক বিধানের পালনের যে চর্চা আমরা দেখি তার পেছনে হাজি শরীয়াত উল্লাহর আন্দোলনের অবদান রয়েছে।
ঊনবিংশ শতকের শেষের দিকে প্রতিষ্ঠিত দেওবন্দ মাদ্রাসা সারা ভারতের ন্যায় বাংলাদেশেও ধর্মীয় সংস্কারে বিপুল অবদান রেখেছে। এ প্রতিষ্ঠানের ফারেগবৃন্দের চেতনায় মুহাম্মাদ ইবন আবদুল ওয়াহহাবের প্রভাব থাকুক বা না থাকুক, শিরক ও বিদআতের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণের সাধারণ কর্মসূচির কারণে ভারতে ও বাংলাদেশে তাঁদেরকে ‘ওয়াহহাবি’ নামে গালি দেয়া হত, এখনো দেয়া হয়। দেওবন্দি ধারার মাদ্রাসাগুলো কোন প্রকারের সরকারি সহায়তা গ্রহণ করে না, এজন্য তাঁরা এগুলোকে কাওমি বা জনগণের সহায়তায় পরিচালিত মাদ্রাসা হিসেবে নামকরণ করেন। কিন্তু কথিত সুন্নীরা গালি দিয়ে কাওমি মাদ্রাসাকে ওয়াহহাবি মাদ্রাসা বলে থাকে, কাওমি আলিমকে ওয়াহহাবি মলই বলে ব্যঙ্গ করা হয়।
সরকারি ধারার মাদ্রাসাগুলোতে এককালে কথিত সুন্নীদের প্রভাব ছিল, বিশেষত চট্টগ্রাম অঞ্চলে, তখন সরকারি মাদ্রাসা ও ওয়াহহাবি মাদ্রাসা ছিল পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী।
কালে কালে বাংলাদেশের অনেক সরকারি মাদ্রাসায় জামায়াত সমর্থনকারী শিক্ষকদের সংখ্যা বেড়ে যায়। তাঁরাও শিরক-বিদআত পরিহারের আহবান জানান। ফলে কাওমি মাদ্রাসা ও সরকারি মাদ্রাসার দ্বান্দ্বিক অবস্থান, সম্পূর্ণরূপে না হলেও অনেকটা শিথিল হয়ে যায়।
বাংলাদেশে শিরক-বিদআত বর্জনের আহবান জানায় এমন আরেকটি গোষ্ঠী রয়েছে, আহলে হাদিস। তাহলে মোটামুটিভাবে বলা যায়, বাংলাদেশে তিনটি ধারার কর্মসূচিতে (নানাবিধ ভিন্নতা সত্ত্বেও) শিরক-বিদআত বর্জনের একটি সাধারণ কর্মসূচি ছিল: (ক) কাওমি ধারা, (খ) সরকারি মাদ্রাসার একাংশ, (গ) আহলে হাদিস।
প্রতিসংস্কার
প্রতিসংস্কার এমতাবস্থায় সৌদি আরবের মাদীনা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ফেরত একদল শায়খ প্রাদুর্ভুত হন দাওয়াতি ময়দানে। তাদের সাথে যোগ দেন আহলে হাদিসের একাংশ, যাঁরা তাঁদের পূর্বসূরিদের প্রজ্ঞা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে রূঢ় একরৈখিকতায় নিমজ্জিত হন। সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করা হয় ফিকহি এখতেলাফে, ইতোপূর্বে শির্ক-বিদআত বিরোধী পক্ষগুলো যা এড়িয়ে চলত। তাঁরা এমনভাবে ইসলামি রাজনীতির বিরোধিতা শুরু করেছেন যে, সেক্যুলাররা তাদের রেফারেন্সে ইসলামী রাজনীতিকে ঘায়েল করছেন। এঁনাদের সবচেয়ে অপ্রয়োজনীয় কাজ বলে আমি মনে করি, আকিদার আলোচনায় এমন কিছু বিষয়ের অবতারণা করা, যে বিষয়ে এদেশের আলিমদের মাঝে ইতিবাচক/নেতিবাচক কোন ধারণা ছিল না। দার্শনিক বিতর্কের যুগে সৃষ্ট এসব আলোচনা ইসলামের প্রাথমিক যুগে ছিল না।
ফলে পাল্টা জবাব আসতে লাগল। নামাজের পদ্ধতি সম্পর্কে পাল্টাপাল্টি বই রচিত হল। আশআরি-মাতুরিদি আলোচনা ঘরে ঘরে শুরু হয়ে গেল, পূর্বের যুগে যা মাদ্রাসার সেরা শিক্ষার্থীদের বোধগম্যতার বহির্ভুত ছিল। না এখনো বাংলাদেশে দৃশ্যমান শির্ক বিদআত আছে। আমি নিজ চোখে দেখেছি, মানুষ কবরে সিজদা করে, লেংটা সুলায়মানের মাজারে মোমবাতি দেয়নি বলে তার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে বলে বিশ্বাস করে, এমন মানুষ আছে। মা্ভাইণ্ডারির মাজারে সিজদা করে জাহান্নামে যেতেও রাজি, এমন মানুষকে আমি নিজ চোখে দেখেছি।
কোনটি এড্রেস করা গুরুত্বপূর্ণ, এগুলো না ওগুলো?
আমাদের ডক্টরবৃন্দ – যাঁরা সুন্নাহ, নফল ও আসাহ্হ নিয়ে ঘন্টার পর ঘণ্টা আলোচনা করেন, যাঁরা কিতাবের পৃষ্ঠার জটিলতম ধর্মতাত্ত্বিক আলোচনার ভিডিও জ্ঞানী-অজ্ঞানীর জন্য ইউটিউবে ছেড়ে দেন-
এরা না ঊনবিংশ শতকের স্বল্পজ্ঞানী সংস্কারকবৃন্দ- যাঁরা মোটাদাগে কয়েকটি দফা নির্ধারণ করে শির্ক-বিদআহ ও কুসংস্কার দুরীকরণে অবতীর্ণ হয়েছিলেন-
কারা অধিক প্রজ্ঞাবান?