শনিবার, ০৫ অক্টোবর, ২০২৪, ২০ আশ্বিন ১৪৩১

এনআইডি কার্ড ৩-৭ দিনেই তৈরি করে দিতো তারা

জীবন যাপন মার্চ ২২, ২০২২, ০৭:০০ পিএম
এনআইডি কার্ড ৩-৭ দিনেই তৈরি করে দিতো তারা

রাজধানীর মালিবাগ,বাসাবো, শাহজাহানপুর ও কোতয়ালী থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে ভুয়া এনআইডি ও ড্রাইভিং লাইসেন্স তৈরির চক্রের মূলহোতাসহ পাঁচ জনকে আটক করেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব)। 

সোমবার (২১ মার্চ) গোয়েন্দা নজরদারির ভিত্তিতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে চক্রটির সদস্যদের আটক করে র‍্যাব-৩।

আটক ব্যক্তিরা হলেন, চক্রের মূলহোতা গোলাম মোস্তফা (৬০), তার চার সহযোগী জালাল বাশার (৫৪), মুসলিম উদ্দিন (৬৫), মিনারুল ইসলাম মিন্নি (২২) ও তারেক মৃধা (২১)। এ চক্রের আরও একজন সদস্য রয়েছেন। তিনি বর্তমানে সৌদি আরবে রয়েছেন বলে র‍্যাব জানিয়েছে।

আটকের সময় তাদের কাছ থেকে ২টি কম্পিউটার, ২ হাজার ৪৬০টি বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের জাল প্রাপ্তিস্বীকার রশিদ, ২৬টি ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র, ১টি ল্যাপটপ, ১টি ডিজিটাল ক্যামেরা, ১৮টি ভুয়া ড্রাইভিং লাইসেন্স, ৮০টি সাদা রঙের প্লাস্টিকের ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র ও ড্রাইভিং লাইসেন্স তৈরির ব্লাঙ্ক কার্ড, ৫০টি স্বচ্ছ কার্ড হোল্ডার, ২টি সিকিউরিটি লেমিনেটিং পেপার, ১টি কার্ড প্রিন্টার, ৪টি সফ্টওয়্যারের সিডি, ৪টি পেনড্রাইভ, ৫টি মোবাইল ফোন ও নগদ ২ হাজার ৮০০ টাকা জব্দ করা হয়েছে।

র‍্যাব সূত্রে জানা যায়, চক্রটি সাধারণত নির্বাচন কমিশন ও বিআরটিএ অফিসের সামনে অবস্থান করে যাদের খুব দ্রুত এনআইডি কার্ড বা ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রয়োজন তেমন লোকজনকে তারা টার্গেট করতো। গ্রাহকদের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনের জন্য ওইসব অফিসের নিরাপত্তা কর্মীদের সঙ্গে নানা কৌশলে সখ্য রয়েছে বলে দেখাতো। পরে গ্রাহকরা রাজি হলে তাদের সঙ্গে এনআইডি বা ড্রাইভিং লাইসেন্স তৈরির জন্য ৩-৪ হাজার টাকা নিতো। আবার যাদের দ্রুত প্রয়োজন তাদের কাছ থেকে ক্ষেত্র বিশেষে ৮-১০ হাজার টাকা করে নিতো। এভাবে প্রতি মাসে চক্রটি ৩০টি করে ভুয়া এনআইডি বা ড্রাইভিং লাইসেন্স গ্রাহকদের দিতো। সাধারণত চক্রটি ৩-৭ দিনে এসব ভুয়া কার্ড দিতো। ক্ষেত্র বিশেষে এক দিনেও তৈরি করে দিতো।

আরও জানা যায়, চক্রটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও বেশ সক্রিয় ছিল। বিভিন্ন ফেসবুক পেজ খুলে চটকদার বিজ্ঞাপন দিতো এনআইডি ও ড্রাইভিং লাইসেন্স তৈরি করে দেওয়ার। গ্রাহকরা এসব বিজ্ঞাপন দেখে আগ্রাহী হলে তাদেরও এসব ভুয়া কার্ড দিতো চক্রটি টাকার বিনিময়ে।

মঙ্গলবার (২২ মার্চ) দুপুরে কারওয়ান বাজার র‍্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, আটকদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, তারা গত ৮-১০ বছর ধরে ভুয়া এনআইডি কার্ড, ড্রাইভিং লাইসেন্স ও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জাল সার্টিফিকেটসহ অন্যান্য জাল নথিপত্র তৈরি করে আসছিল। মোস্তফা এ চক্রের মূলহোতা, বাকিরা তার সহযোগী। চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন নির্বাচন অফিস ও বিআরটিএ অফিসের সামনে অবস্থান করে গ্রাহকদের টার্গেট করতো। গ্রাহকদের দ্রুত সময়ের মধ্যে ড্রাইভিং লাইসেন্স ও জাতীয় পরিচয়পত্র প্রাপ্তির নিশ্চয়তা দিয়ে প্রতারণা করত। 

গ্রাহকদের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনে তারা হুবহু জাল প্রাপ্তি স্বীকারপত্র ও মানি রিসিটটি ভুয়া সীল ও স্বাক্ষর ব্যবহার করে গ্রাহকদের দিতো। একইভাবে তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন গ্রুপে চটকদার বিজ্ঞাপন পোস্ট করত। পরে কোনো গ্রাহক তাদের সঙ্গে এনআইডি/ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য যোগাযোগ করলে তারা দ্রুততম সময়ে কাজ করে দেওয়ার অফার দিত। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করার ক্ষেত্রে তার ফেইক আইডি ব্যবহার করতো চক্রটি।

তিনি বলেন, চক্রটি প্রতিটি ভুয়া ড্রাইভিং লাইসেন্স ও এনআইডি কার্ডেরের জন্য গ্রাহকদের কাছ থেকে ৩-৪ হাজার টাকা নিতো। এছাড়া দ্রুত এনআইডি/ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে হলে গ্রাহকদের চক্রটিকে ৮-১০ হাজার টাকা দিতে হতো। এক্ষেত্রে তারা বাইক রাইডার, লাইসেন্স বিহীন বিভিন্ন গাড়ির চালক যারা দ্রুত সময়ের মধ্যে ড্রাইভিং লাইসেন্স/এনআইডি পেতে আগ্রহী অথবা যারা অবৈধভাবে লাইসেন্স/এনআইডি প্রত্যাশী তাদের টার্গেট করে থাকে। গ্রাহকদের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে বিশ্বসযোগ্যতা অর্জনের জন্য তারা সাধারণত বিভিন্ন বিআরটিএ অফিস, নির্বাচন কমিশন অফিস বা সংশ্লিষ্ট অফিসের আশেপাশে দেখা করতো। পরে তারা ৩-৭ দিনের মধ্যে ভুয়া ড্রাইভিং লাইসেন্স/এনআইডি সরবরাহ করতো। জরুরি ক্ষেত্রে অতিরিক্ত অর্থের বিনিময়ে তারা একদিনের মধ্যেই সরবরাহ করে থাকে।

তিনি আরও বলেন, গোলাম মোস্তফা এইচএসসি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে। আনুমানিক ৩০ বছর আগে সে ঢাকায় আসে। ঢাকায় এসে সে ডেন্টাল মেডিকেল কলেজ থেকে এক্সরে মেশিন টেকনিশিয়ানের ১ বছরের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। পরে সে একটি ক্লিনিকে ৫-৭ বছর এক্সরে মেশিন টেকনিশিয়ান হিসেবে চাকরি করে। মোস্তফা ২০০০ সালে নিজে একটি এক্সরে মেশিন নিয়ে ছোট দোকান দেয়। ২০১০ সালে তিনি প্রতারণার সঙ্গে জড়িত হয়। একই ধরনের প্রতারণায় তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে এবং একাধিকবার তিনি জেল খেটেছেন।

এক প্রশ্নের জবাবে কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, যারা এসব ভুয়া ড্রাইভিং লাইসেন্স বা এনআইডি ব্যবহার করছেন তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়ে নিয়মিত এসব ভুয়া কার্ডের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নিয়ে থাকি।

এ চক্রের সঙ্গে সংশ্লিট সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তারা জড়িত কিনা জানতে চাইলে র‍্যাবের মুখপাত্র বলেন, এরা বিভিন্ন সময় নির্বাচন কমিশন অফিস ও বিআরটিএ এর সামনে অবস্থান করতো। এরা নিজেদের বিশ্বাসযোগত্যা অর্জনে এসব অফিসের নিরাপত্তার কাজে যারা থাকেন তাদের সঙ্গে সু-সম্পর্ক রয়েছে প্রতারণার মাধ্যমে গ্রাহকদের দেখিয়েছেন। তবে এখন পর্যন্ত সরকারি কোনো কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সঙ্গে এ চক্রের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া যায়নি।  

এ ভুয়া এনআইডি সিম কিনতে বা পাসপোর্ট তৈরি করতে ব্যবহার করা হতো কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, যাদের জরুরি প্রয়োজন হয়েছে অনেকেই তাদের কাছ থেকে এভাবে এনআইডি কার্ড নিয়েছে। আর যারা দ্রুত লাইসেন্স পেতে চান তারাও এ চক্রের কাছে ধরা দেয়।

এ সময় সবার উদ্দেশ্যে র‍্যাবের এ কর্মকর্তা বলেন, চটকদার বিজ্ঞাপন দেখে কেউ এসব চক্রের ফাঁদে জড়িয়ে যাবেন না। সঠিক তথ্য যেন যাচাই সব সময় দেখবেন। প্রতারিত হওয়ার আগে সতর্ক হওয়া জরুরি।

Side banner