সোমবার, ১৩ অক্টোবর, ২০২৫, ২৮ আশ্বিন ১৪৩২

নোবেল পুরস্কার ২০২৫: কী, কখন এবং কারা পাচ্ছেন এ বছরের স্বীকৃতি

জীবন যাপন অক্টোবর ৬, ২০২৫, ০৮:৫৫ পিএম
নোবেল পুরস্কার ২০২৫: কী, কখন এবং কারা পাচ্ছেন এ বছরের স্বীকৃতি

বিশ্বজুড়ে আবারও শুরু হলো নোবেল পুরস্কারের উত্তেজনা ও প্রতীক্ষা। প্রতি বছরের মতো এবারও শারীরবিদ্যা বা চিকিৎসাবিজ্ঞানের পুরস্কার ঘোষণার মাধ্যমে সোমবার (৬ অক্টোবর) আনুষ্ঠানিকভাবে সূচনা হলো নোবেল পুরস্কার ২০২৫-এর। একে একে আগামী এক সপ্তাহ ধরে ঘোষণা করা হবে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, সাহিত্য, শান্তি ও অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ীদের নাম।

পুরস্কার ঘোষণার এই ধারাবাহিকতা চলবে ৬ অক্টোবর থেকে ১৩ অক্টোবর পর্যন্ত, এবং বছরের অন্যতম আলোচিত সপ্তাহে পরিণত হবে বিশ্বজুড়ে।

নোবেল পুরস্কার কী?

নোবেল পুরস্কার হলো বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানজনক আন্তর্জাতিক পুরস্কারসমূহের একটি সেট, যা প্রবর্তন করেছিলেন সুইডিশ বিজ্ঞানী ও উদ্ভাবক আলফ্রেড নোবেল। তিনি ছিলেন ডাইনামাইটের আবিষ্কারক এবং একজন প্রকৌশলী ও শিল্পপতি।

১৮৯৫ সালে লেখা তাঁর উইলে নোবেল ঘোষণা করেন, তাঁর সম্পদের মূল অংশ ব্যবহার করে প্রতি বছর এমন ব্যক্তিদের পুরস্কৃত করা হবে, যারা “মানবজাতির কল্যাণে সর্বাধিক অবদান রেখেছেন।”

প্রথম নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয় ১৯০১ সালে, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসাবিজ্ঞান, সাহিত্য ও শান্তি—এই পাঁচটি ক্ষেত্রে। পরে, ১৯৬৮ সালে সুইডেনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক Sveriges Riksbank আলফ্রেড নোবেলের স্মৃতিতে অর্থনীতিতে পুরস্কার সংযোজন করে।

কারা দেয় এই পুরস্কার?

বিভিন্ন ক্ষেত্রের জন্য নোবেল পুরস্কার প্রদান করে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিষ্ঠান—

Karolinska Institutet (চিকিৎসাবিজ্ঞান)

Royal Swedish Academy of Sciences (পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও অর্থনীতি)

Swedish Academy (সাহিত্য)

Norwegian Nobel Committee (শান্তি পুরস্কার)

প্রত্যেক বিজয়ী পান একটি সোনার মেডেল, ডিপ্লোমা ও নগদ অর্থ পুরস্কার। এ বছর পুরস্কারের অর্থমূল্য ধরা হয়েছে ১১ মিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনা (প্রায় ১.২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার)।

চিকিৎসাবিজ্ঞানে কী আসতে পারে এই বছর?

এ বছর চিকিৎসাবিজ্ঞানের নোবেল নিয়ে সবচেয়ে বেশি জল্পনা ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণকারী হরমোন সংক্রান্ত গবেষণা নিয়ে।

বিশ্বে এখন স্থূলতায় আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা এক বিলিয়নেরও বেশি। এই প্রেক্ষাপটে GLP-1 হরমোন বা Glucagon-like Peptide 1 আবিষ্কার ও তার প্রয়োগকে কেন্দ্র করে উদ্ভাবিত ওষুধ—Ozempic, Wegovy, Mounjaro—বিশ্বজুড়ে চিকিৎসা পদ্ধতিতে বিপ্লব এনেছে।

এই আবিষ্কারের জন্য সম্ভাব্য বিজয়ী হিসেবে আলোচনায় রয়েছেন—
জেন্স জুয়েল হোলস্ট, জোয়েল হাবেনার, ড্যানিয়েল ড্রাকার ও স্বেতলানা মোইসোভ।

অন্যদিকে, জাপানি বিজ্ঞানী কেনজি কাংগাওয়া ও মাসায়াসু কোজিমা-ও আলোচনায় রয়েছেন Ghrelin হরমোন আবিষ্কারের জন্য, যা ক্ষুধা বাড়ায়—এভাবে বিষয়টি হতে পারে এক বৈজ্ঞানিক ভারসাম্যের প্রতিফলন, যেমন ১৯৯৪ সালে আবিষ্কৃত হয়েছিল Leptin।

পদার্থবিজ্ঞানে আলোচনায় “অদৃশ্য চাদর”

পদার্থবিজ্ঞানে এ বছর আলোচনায় রয়েছেন ব্রিটিশ পদার্থবিদ জন পেনড্রি, যিনি metamaterials বা কৃত্রিম উপাদান ব্যবহার করে “অদৃশ্য চাদর” তৈরির প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন। এই পদ্ধতিতে কোনো বস্তুর চারপাশে তড়িৎচৌম্বকীয় তরঙ্গকে এমনভাবে ঘুরিয়ে দেওয়া যায়, যেন তা চোখে দেখা না যায়—একে বলা হয় “ইনভিজিবিলিটি ক্লোক”।

শান্তি পুরস্কার নিয়ে বিশ্বজোড়া নজর

চলমান যুদ্ধ, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও রাজনৈতিক সংকটের প্রেক্ষাপটে এ বছরের নোবেল শান্তি পুরস্কার বিশেষ আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে।

গাজায় গণহত্যা, ইউক্রেনের যুদ্ধ, ও বিভিন্ন দেশে গৃহযুদ্ধ—সবকিছু মিলিয়ে এ বছর শান্তির প্রশ্নে বিশ্ব এক অস্থির সময় পার করছে।

অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেকে শান্তি পুরস্কারের যোগ্য দাবিদার বলে প্রচার করছেন। তিনি দাবি করেছেন, “সাতটি যুদ্ধ শেষ করার” জন্যই তিনি নোবেল পাওয়ার যোগ্য। যদিও বিশেষজ্ঞদের মতে, নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি সাধারণত টেকসই শান্তি ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতাকে গুরুত্ব দেয়, ব্যক্তিগত প্রচারণাকে নয়।

একাডেমিক স্বাধীনতা নিয়েও আলোচনা

রয়্যাল সুইডিশ একাডেমির সহসভাপতি ইয়লভা ইংস্ট্রোম সতর্ক করেছেন যে যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প প্রশাসনের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে একাডেমিক স্বাধীনতা হুমকির মুখে পড়ছে। তিনি বলেছেন,

“একাডেমিক স্বাধীনতা গণতন্ত্রের অন্যতম স্তম্ভ; এতে হস্তক্ষেপ করলে এর দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হতে পারে।”

নোবেল পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান

প্রতি বছর ১০ ডিসেম্বর, আলফ্রেড নোবেলের মৃত্যুবার্ষিকীতে, অনুষ্ঠিত হয় নোবেল পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান।

স্টকহোমে রাজপরিবারের উপস্থিতিতে প্রদান করা হয় পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসাবিজ্ঞান, সাহিত্য ও অর্থনীতির পুরস্কার।
অসলো সিটি হলে, নরওয়ের নোবেল কমিটির চেয়ারম্যান শান্তি পুরস্কার তুলে দেন বিজয়ীর হাতে।

এরপর স্টকহোম সিটি হলে আয়োজিত হয় এক জাঁকজমকপূর্ণ নোবেল ভোজসভা, যেখানে উপস্থিত থাকেন এক হাজারেরও বেশি অতিথি—রাজপরিবার, কূটনীতিক, বিজ্ঞানী ও পূর্বের বিজয়ীরা।

গত বছরের বিজয়ীরা কারা ছিলেন?

চিকিৎসাবিজ্ঞান: ভিক্টর অ্যামব্রোস ও গ্যারি রুভকুন (microRNA আবিষ্কারের জন্য)
পদার্থবিজ্ঞান: জন জে. হপফিল্ড ও জিওফ্রে হিনটন (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও নিউরাল নেটওয়ার্কের ভিত্তি স্থাপনের জন্য)
রসায়ন: ডেভিড বেকার, ডেমিস হাসাবিস ও জন জাম্পার (প্রোটিন স্ট্রাকচার পূর্বাভাসে AI ব্যবহারের জন্য)
সাহিত্য: দক্ষিণ কোরীয় লেখিকা হান কাং (“দ্য ভেজিটেরিয়ান” ও “হিউম্যান অ্যাক্টস”-এর জন্য)
শান্তি: Nihon Hidankyo, জাপানের পরমাণু হামলায় বেঁচে থাকা ভুক্তভোগীদের সংগঠন
অর্থনীতি: দারন অ্যাসেমোগ্লু, সাইমন জনসন ও জেমস রবিনসন (প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও অর্থনৈতিক অসমতা নিয়ে গবেষণার জন্য)

নোবেল পুরস্কার শুধু বৈজ্ঞানিক বা সাহিত্যিক সাফল্যের স্বীকৃতি নয়—এটি মানবজাতির জন্য জ্ঞানের, চিন্তার ও শান্তির এক অনন্ত যাত্রার প্রতীক। ২০২৫ সালের এই নোবেল সপ্তাহে, আবারও বিশ্ব তাকিয়ে থাকবে সেইসব মানুষদের দিকে, যারা তাঁদের গবেষণা, কলম বা কর্মে বিশ্বকে বদলে দিচ্ছেন।

Side banner