শনিবার, ০৫ অক্টোবর, ২০২৪, ২০ আশ্বিন ১৪৩১
গর্ভবতী হওয়ায় আগে বা পরে একজন নারীর নানা ধরণের রোগ হতে পারে। সেটা হতে পারে জেনেটিক বা সাধারণ রোগ। এক্ষেত্রে তার গর্ভাবস্থায় ঝুঁকি বাড়ে। তবে ফলিক এসিড গ্রহণ করলে শতকরা ৮০ ভাগ গর্ভাবস্থার ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব। এছাড়া গর্ভবতী নারী রোগীদের চিকিৎসায় ফিটোমেটারনাল মেডিসিনসহ রয়েছে আরো নানা ধরণের পদ্ধতি। এসব বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিটোমেটারনাল মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. ফিরোজা বেগম।
ফিটোমেটারনাল মেডিসিন সম্পর্কে কিছু বলুন?
ফিটোমেটারনাল মেডিসিনের মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভাবস্থায় চিকিৎসা দেয়া হয়। এক্ষেত্রে গর্ভাবতী হবার আগে থেকে শুরু করে গর্ভাবস্থায় এবং গর্ভাবস্থার পরেও এই চিকিৎসা দেয়া হয়। ফিটোমেটারনাল মেডিসিনের মাধ্যমে বাচ্চা এবং মায়ের চিকিৎসা দেয়া হয়। এক্ষেত্রে মায়ের ডেলিভারি কেয়ার এবং পোস্ট ডেলিভারি কেয়ারও নেয়া হয়।
ফিটোমেটারনাল মেডিসিনের মাধ্যমে কি কি চিকিৎসা দেয়া হয়?
প্রেগনেন্সিতে ফিটোমেটারনাল মেডিসিন দিয়ে শুধু ঝুঁকিপূর্ণ মায়েদের চিকিৎসা দেয়া হয়। কোন কোন মায়ের আগে থেকেই ডায়াবেটিস, হাইপার টেনশন, উচ্চ রক্তচাপ, বারবার প্রেগনেন্সি লস হওয়া, কিডনির সমস্যা, হার্টের সমস্যা, ম্যালিগনেন্সি ইত্যাদি সমস্যা থাকে। এক্ষেত্রে ফিটোমেটারনাল মেডিসিন এর চিকিৎসা দেয়া হয়। এটা কখনও কখনও গর্ভাবস্থার আগে থেকে শুরু করা হয়। আবার গর্ভাবস্থায় কোন সমস্যা হলে ফিটোমেটারনাল মেডিসিন এর চিকিৎসা দেয়া হয়।
পরিবেশ দূষণ কিংবা পরিবেশের কোন বাধা এড়িয়ে চললে গর্ভাবস্থায় ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব?
পরিবেশের কিছু কিছু উপাদান আমাদের শরীরের ক্রোমোজোমকে নষ্ট করে দেয়। বর্তমানে আমরা সার দেয়া এবং প্রিজারভেটিভ খাবার বেশি খেয়ে থাকি। এটাও গর্ভাবস্থায় বাচ্চার বা ভ্রুণের ক্ষতি করতে পারে। আবার মানুষ বেশি বয়সে বাচ্চা নিলে তার মধ্যে ক্রোমোজোমাল সমস্যা চলে আসে। এটা মেয়েদের ক্ষেত্রেও আবার তার স্বামীর স্পার্মেও আসতে পারে। প্রেগনেন্সির ক্ষেত্রে একটা সুস্থ স্পার্ম এবং একটা সুস্থ ভ্রুণ লাগে। এই ভ্রুণটি আস্তে আস্তে বড় হয় এবং পরবর্তীতে এটি সুস্থ বাচ্চায় পরিণত হয়। কিন্তু এই ভ্রুণটি প্রথমে যখন হয় তারপর মিলিয়ন মিলিয়ন টাইমস ডিভিশন হয়। এই ডিভিশনের সময় বিশেষ করে প্রথম তিন মাসে কোথাও কোন ত্রুটি হলে বাচ্চার সমস্যা হতে পারে ।
প্রি প্রেগনেন্সি কাউন্সিলিংয়ের ক্ষেত্রে কি কি বিষয়ে মনোযোগ দেয়া উচিত?
কোনো মায়ের শারীরিক কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু তার শরীরের তুলনায় ওজন বেশি হলে বাচ্চার সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। এসব মায়েদের ক্ষেত্রে ডায়াবেটিস হওয়ার আশংকা বেশি থাকে। তাই মায়ের ওজন নিয়ন্ত্রণ করে প্রেগনেন্সিতে যাওয়া উচিত। এছাড়া প্রত্যেক মায়েদেরই প্রি প্রেগনেন্সি চেকআপ করানো উচিত। কোন মায়ের থাইরয়েডের সমস্যা রয়েছে। এক্ষেত্রে হাইপোথাইরয়েড হলে তাকে থাইরয়েডের ওষুধ দিলে হরমোন লেভেল স্বাভাবিক হয়ে আসে। এরপর তিনি প্রেগন্যান্ট হলে ঝুঁকি কমে আসে।
আবার কোনো মা আছেন তারা জানেন না যে, তাদের ডায়াবেটিস। সেক্ষেত্রে প্রি প্রেগনেন্সি পরীক্ষা করে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে তারা প্রেগনেন্সিতে যেতে পারেন। এর ফলে গর্ভাবস্থায় ঝুঁকি কমে যায়। আবার মা হাইপারটেনসিভের রোগী থাকেন। এক্ষেত্রে তিনি এমন কিছু কিছু ওষুধ খান যেটা তার প্রেগনেন্সিতে ঝুঁকি হতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রি প্রেগনেন্সি পরীক্ষার সময় চিকিৎসকরা যেসব ওষুধ গর্ভাবস্থায় ঝুঁকির কারণ, সেগুলো পরিবর্তন করে নতুন ওষুধ দিতে পারেন। তাই প্রতিটি মায়ের প্রি প্রেগনেন্সি পরীক্ষার পর গর্ভবতী হবার সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত।
বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার মতে, সারাবিশ্বে প্রতিনিয়ত ৭.৯ মিলিয়ন বাচ্চার জন্মগত সমস্যা হচ্ছে। এটা নিয়ে আমাদের দেশে কোনো গবেষণা হচ্ছে কি?
সাধারণত আমাদের দেশে শিশুদের জন্মগত সমস্যা নিয়ে কেউ কাজ করছে না। এ ব্যাপারে গ্রামগঞ্জে, শহর পর্যায়ে, মেডিকেল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় কোনো লেভেলে এখন পর্যন্ত কোন কাজ শুরু করা হয়নি। এখানেই ফিটোমেটারনাল মেডিসিনের ভূমিকা অনেক বেশি।
জেনেটিক সমস্যা থাকলে গর্ভবতী মায়ের চিকিৎসা কিরূপ?
প্রিপ্রেগনেন্সি কাউন্সিলিং করে গর্ভাবস্থায় ঝুঁকি কিছুটা এড়ানো সম্ভব। কিন্তু মা-বাবার মধ্যে কোন জেনেটিক্যাল সমস্যা থাকলে সেটা বাচ্চার মধ্যে এসে পড়ে। এ ধরনের সমস্যা দূর করতে আমাদের দেশে জেনেটিসিস্ট দরকার। কিন্তু আমাদের দেশে তা নেই। এক্ষেত্রে আমাদের এই দুঃখজনক সত্যটি মেনে নিয়ে অন্যান্য মেডিকেল চিকিৎসার সহায়তা নিতে হবে।
আমাদের দেশে জেনেটিসিস্টের অনেক অভাব রয়েছে, সেক্ষেত্রে সরকারিভাবে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে কিনা?
এক্ষেত্রে আমাদের দেশে কিছু পরিমাণে কাজ করা হচ্ছে কিন্তু পুরোপুরি সাফল্য পেতে অনেক সময়ের প্রয়োজন হবে।
কোন মায়ের পরপর তিন- চারটি বাচ্চা গর্ভাবস্থায় নষ্ট হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে ওই মাকে কিভাবে আশ্বস্ত করা যায়?
এক্ষেত্রে গর্ভবতী মা, তার স্বামী, এবং শাশুড়ি সবাইকেই কাউন্সেলিং করা হয়। এক্ষেত্রে গর্ভবতী মাকে মানসিক সহায়তা দেয়া হয়। তাদের সান্তনা দিয়ে স্বাভাবিক আচরণ করা হয় কষ্ট লাঘব করার উদ্দেশ্যে।
ফিটোমেটারনাল মেডিসিন ক্যারিয়ারে কোন চিকিৎসক কাজ করতে চাইলে তাদের মধ্যে কি কি গুণাবলী থাকতে হবে?
ফিটোমেটারনাল মেডিসিন ক্যারিয়ারে যারা আসতে চায়, তাদেরকে শুধু চিকিৎসক হলেই হবে না, যথেষ্ট মানবিক হতে হবে। রোগীদের মেডিকেল সাপোর্ট এবং মেন্টাল সাপোর্ট দেয়ার মানসিকতা তাদের মধ্যে থাকতে হবে। তাহলে তারা এই ক্যারিয়ারে ভালো করতে পারবে ।
গর্ভাবস্থায় বাচ্চার ত্রুটি ধরা পড়লে চিকিৎসা পদ্ধতি কি?
১১ থেকে ১৪ সপ্তাহের মধ্যে আল্ট্রাসনোগ্রাফি, ব্লাড টেস্ট, এনআইপিটি করে চিকিৎসকরা বুঝতে পারেন বাচ্চাটি ডাউনস কিনা। এছাড়াও ইনভেসিভ টেস্ট এর ক্ষেত্রে মায়ের পেটের পানি এবং গর্ভফুল থেকে কিছু অংশ নিয়ে টেস্ট করে ডাউন সিনড্রোম শনাক্ত করা যায়। এছাড়াও বর্তমানে কিছু কিছু বাচ্চার মাথা বড় থাকছে, পিঠের হাড় যেটা জোড়া থাকার কথা সেটা ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে মায়েরা গর্ভাবস্থার তিন মাস আগে থেকে ফলিক অ্যাসিড খেলে ৮০ ভাগ গর্ভাবস্থার ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব। আর বাকি ২০ ভাগ হচ্ছে জেনেটিক্যাল।
করোনার সময় গর্ভবতী মা ও যারা গর্ভবতী হবার পরিকল্পনা করছেন তাদের জন্য কী পরামর্শ?
করোনার মধ্যে অনেক বেশি সর্তকতা অবলম্বন করতে হবে গর্ভবতী মায়েদের। করোনার এই সময়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। আর যারা প্রেগনেন্সির পরিকল্পনা করছে, তাদের গর্ভবতী হওয়ার তিন মাস আগে থেকেই ফলিক এসিড খেতে হবে গর্ভাবস্থায় ঝুঁকি কিছুটা কমানোর জন্য। করোনা পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার ও মাস্ক পরেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।