শনিবার, ০৫ অক্টোবর, ২০২৪, ২০ আশ্বিন ১৪৩১
মাঠ প্রশাসনে যোগ্য ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তা পদায়নে ফের ‘জনপ্রশাসনে পদায়ন নীতিমালা-২০২১’র খসড়া তৈরি করছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। নীতিমালায় জেলা প্রশাসক (ডিসি), অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নিয়োগে নতুন কিছু শর্ত যুক্ত করা হয়েছে। এসব শর্ত পূরণ না হলে মাঠ প্রশাসনের এসব গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ পাবেন না কোনো কর্মকর্তা। যে কোনো প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) নিয়োগ এবং নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের পদোন্নতির পর পরবর্তী পদায়নসহ কিছু নতুন বিষয় যুক্ত হচ্ছে নীতিমালায়। তবে নীতিমালাটি পুরোপুরি বাস্তবায়ন হওয়া নিয়ে শঙ্কার কথা জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, এর আগেও নীতিমালা হয়েছে। কিন্তু পদায়নের ক্ষেত্রে সেটি অনুসরণের নজির খুবই কম।
নীতিমালা অনুযায়ী, কর্ম এলাকায় যেসব কর্মকর্তার সুনাম ও গ্রহণযোগ্যতা নেই তাদের প্রত্যাহার করা হবে। কিন্তু কর্মকর্তাদের সুনাম ও গ্রহণযোগ্যতা কীভাবে যাছাই করা হবে তা খসড়া নীতিমালায় বলা হয়নি। কিংবা প্রত্যাহার করা কর্মকর্তাকে পুনরায় একই পদে অন্য কর্মস্থলে পদায়ন করা হবে কিনা সেটিও স্পষ্ট করা হয়নি। প্রশাসন ক্যাডারের একাধিক কর্মকর্তা অভিযোগের সুরে বলেন, নীতিমালা শুধু ‘দুর্বল’ কর্মকর্তা অর্থাৎ যাদের জন্য তদবির নেই তাদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হয়। প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে নীতিমালা বাস্তবায়ন হয় না। তারা নীতিমালা অনুযায়ীযোগ্য না হলেও পদায়ন নিতে পারেন।
একাধিক কর্মকর্তা জানান, জনপ্রশাসনে পদায়ন নীতিমালায় বেশ কিছু বিষয় অস্পষ্ট। যেমন- কোনো কর্মকর্তার নামে বিভাগীয় মামলা থাকলে কিংবা মামলায় শাস্তি হলে তাকে ইউএনও, ডিসি বা বিভাগীয় কমিশনার পদে পদায়ন করা যাবে কিনা তা উল্লেখ নেই। বিষয়টি স্পষ্ট হওয়া জরুরি। নীতিমালায় বলা আছে একজন কর্মকর্তাকে তার নিজ জেলা বা তার স্বামী/স্ত্রীর নিজ জেলায় পদায়ন করা যাবে না। যে কর্মকর্তা সহকারী কমিশনার (ভূমি) বা এসিল্যান্ড পদে যে উপজেলায় দায়িত্ব পালন করেছেন তাকে একই উপজেলায় ইউএনও পদে পদায়ন করা যাবে না। কিন্তু বাস্তবে এ নিয়ম লঙ্ঘন করে অনেকেই পদায়ন নিয়েছেন। প্রশাসনে এ রকম বহু নজির আছে।
খসড়া নীতিমালাটি অনুমোদনের জন্য শিগগিরই প্রশাসনিক উন্নয়নসংক্রান্ত সচিব কমিটিতে উঠবে বলে জানা গেছে। এটি চূড়ান্ত অনুমোদন পেলে বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদায়ন নীতিমালা-২০১৫ এবং জেলা প্রশাসক, অতিরিক্তি জেলা প্রশাসক, ইউএনও এবং মহানগর হাকিম হিসেবে কর্মকর্তা নির্বাচন বা পদায়নের নীতিমালা-১৯৯৭ (সংশোধিত ২০১০, ২০১৩, ২০১৫) রহিত হবে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ অনুবিভাগের (এপিডি) অতিরিক্ত সচিব আনিছুর রহমান মিঞা বলেন, জনপ্রশাসনে পদায়ন নীতিমালা নিয়ে কাজ চলছে। এখনো চূড়ান্ত হয়নি। আরও ২-৩টি মিটিং হবে। তার পরই নীতিমালাটি চূড়ান্ত হবে বলে আশা করছি।
বিভাগীয় মামলায় শাস্তি হলে বা মামলা চলমান থাকলে কোনো কর্মকর্তাকে মাঠ প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করার বিষয়ে নীতিমালায় কী থাকছে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, বিভাগীয় মামলা চললে আমরা অনেক সময় তাদের ওএসডি করি। নীতিমালা চূড়ান্তের আগে নিশ্চয়ই আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা হবে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কেএম আলী আজম বিদেশে থাকায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
ডিসি পদে পদায়নের যোগ্যতা
বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের কর্মকর্তাদের উপসচিব পদে পদোন্নতির এক বছর ব্যাচভিত্তিক ডিসি পদে নিয়োগ দেওয়া যাবে। এর আগে বর্তমান নিয়মের মতোই উপযুক্ত কর্মকর্তাদের তালিকা (ফিটলিস্ট) তৈরি করতে হবে। ফিটলিস্ট তৈরিতে যেসব বিষয় বিবেচনায় নিতে নীতিমালায় বলা হয়েছে- ১. উপপরিচালক, স্থানীয় সরকার/অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক/ইউএনও/জেলা পরিষদের সচিব/পৌরসভার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পদে কমপক্ষে দুই বছর চাকরির অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। ২. ডিসি পদে নিয়োগের আগের ৫ বছরের বার্ষিক গোপনীয় অনুবেদনের রেকর্ড এবং সমগ্র চাকরি জীবনের শৃঙ্খলা প্রতিবেদন সন্তোষজনক হতে হবে। ৩. ম্যাজিস্ট্রেসি ও ভূমি প্রশাসন বিষয়ে পর্যাপ্ত অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। ৪. অভ্যন্তরীণ ও বিদেশে লব্ধ উচ্চতর প্রশিক্ষণের মূল্যায়ন করা হবে। ৫. চাকরিকালের সততা ও সুনাম গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হবে। ৬. একই কর্মচারী দুটির বেশি জেলায় ডিসির দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না এবং তার কর্মকাল হবে ৩ বছর। এলাকায় যাদের সুনাম ও গ্রহণযোগ্যতা নেই তাদের প্রত্যাহার করা যাবে।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক পদের যোগ্যতা
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক পদে পদায়নের জন্য অবশ্যই ইউএনও পদে দায়িত্ব পালন করতে হবে। কর্মকর্তাদের ডোসিয়ারসহ ৫ বছরের বার্ষিক গোপনীয় অনুবেদনের মূল্যায়ন এবং এই ক্ষেত্রে গড় প্রাপ্ত নম্বর কমপক্ষে ৮০ শতাংশ হতে হবে। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) পদে পদায়নের ক্ষেত্রে সহকারী কমিশনার ও ইউএনও পদে কাজের অভিজ্ঞতা থাকতেই হবে। বিশেষ প্রশাসনিক কারণ ছাড়া অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের সাধারণ কর্মকাল এক বা একাধিক কর্মস্থলে ২ বছর হবে।
ইউএনও পদের যোগ্যতা
পুরনো নিয়মেই যোগ্যদের ফিটলিস্ট তৈরি করতে হবে। এ জন্য যেসব বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে সেগুলো হলো- ১. সিনিয়র স্কেলপ্রাপ্তি ও ৬ বছর চাকরিকাল পূর্ণ হলে ইউএনও পদে পদায়ন করা যাবে। ২. ইউএনও পদে পদায়নের ক্ষেত্রে সহকারী কমিশনার (ভূমি) পদে কমপক্ষে এক বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। তবে কেউ সরকার অনুমোদিত শিক্ষা ছুটিতে থাকলে সহকারী কমিশনার (ভূমি) পদে এক বছরের চাকরির অভিজ্ঞতা শিথিল করা যাবে। ৩. সর্বশেষ ৫ বছরের বার্ষিক গোপনীয় অনুবেদন, সার্ভিস রেকর্ড ও শৃঙ্খলাজনিত প্রতিবেদন সন্তোষজনক হতে হবে। ৪. চাকরিকালীন সততা ও সুনাম বিবেচনা করা হবে। ৫. পদায়নের ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠতা বিবেচনা করা হবে। ৫. ইউএনও পদে বিবেচনাধীন কর্মকর্তার পূর্ববর্তী ৫ বছরের গোপনীয় অনুবেদনে গড় নম্বর কমপক্ষে ৮০ শতাংশ হতে হবে। ৬. এলাকায় যাদের সুনাম ও গ্রহণযোগ্যতা নেই তাদের প্রত্যাহার করা যেতে পারে। ৭. একজন ইউএনওর সাধারণ কর্মকাল হবে ২ বছর। তবে এক বা একাধিক কর্মস্থলে কর্মকাল ৩ বছরের বেশি হবে না। বিশেষ কারণ ছাড়া ইউএনও পদে ২ বছর হলে বিভাগীয় কমিশনার একই বিভাগের অন্য জেলার কোনো উপজেলায় তাকে বদলি করতে পারবেন। তবে একই জেলার অন্য উপজেলায় বদলি বা পদায়ন করা যাবে না।
নন-ক্যাডারদের জন্য যা রয়েছে
নতুন নীতিমালায় বলা হয়েছে, পদোন্নতিপ্রাপ্ত নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের বর্তমান কর্মস্থল থেকে বদলি করে অন্য মন্ত্রণালয়ে পদায়ন করা হবে। মাঠ প্রশাসনে কমপক্ষে পাঁচ বছরের কাজের অভিজ্ঞতা না থাকলে প্রশাসন ক্যাডারের কোনো কর্মকর্তাকেই মন্ত্রণালয়ে পদায়ন করা হবে না। মন্ত্রণালয় ও বিভাগে কাউকে পদায়ন করা হলে সেখানে তিনি দুই বছর চাকরি করবেন। দুই বছরের আগে তাকে বদলি করা যাবে না। আবার তিন বছরের বেশি সেখানে থাকতে পারবেন না। বর্তমানে নন-ক্যাডারের কোনো কোনো কর্মকর্তা পদোন্নতির পরও একই দপ্তরে বছরের পর পর চাকরি করে যাচ্ছেন। কোনো সহকারী সচিব, সিনিয়র সহকারী সচিব ও উপসচিব সচিবালয়ে পদায়িত থাকলে অভিজ্ঞতার জন্য তাকে মাঠ প্রশাসনের পদে পদায়ন করার কথা রয়েছে নতুন নীতিমালায়।
প্রকল্পের পিডি নিয়োগ
জনপ্রশাসনে পদায়ন নীতিমালা অনুযায়ী, একজন প্রকল্প পরিচালককে (পিডি) একটি প্রকল্প শেষ হওয়ার পর পরই আরেকটি প্রকল্পের পিডি করা যাবে না। প্রকল্পে নিয়োগের ক্ষেত্রে অবশ্যই প্রকল্প ব্যবস্থাপনার ওপর মৌলিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বা ওই বিষয়ে পড়াশোনা থাকতে হবে। প্রয়োজনে প্রকল্প বাস্তবায়নসংক্রান্ত বাস্তবভিত্তিক প্রশিক্ষণ দেওয়ার মাধ্যমে একটি দক্ষ পিডি পুল গঠন করতে হবে। পিডি পুল থেকে কর্মকর্তাদের প্রকল্পগুলোতে পদায়ন করা যাবে। কোনো প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ৫০ কোটি টাকা বা তার বেশি হলেই পূর্ণকালীন পিডি নিয়োগ করতে হবে।