শনিবার, ০৫ অক্টোবর, ২০২৪, ২০ আশ্বিন ১৪৩১
বিষাক্ত পোলট্রি খাদ্যে ঝুঁকিতে জনস্বাস্থ্য। পোলট্রি মুরগিতে রয়েছে প্রচুর প্রোটিন। যা শরীরের জন্য খুব দরকার। কিন্তু সেই পোলট্রি মুরগির খাবারে মেশানো হচ্ছে বিষাক্ত বর্জ্য। এতে মুরগির মাংস ও ডিম দুটিই ক্ষতিকর হয়ে ওঠে। সম্প্রতি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় ব্রয়লার মুরগির খাবারে ক্ষতিকর চারটি ভারী ধাতু পাওয়া গেছে। এগুলো হলো—নিকেল, ক্রোমিয়াম, সিসা ও আর্সেনিক। এসব ভারী ধাতুর কারণে মানুষের ক্লোন ক্যানসার, পাকস্থলী ক্যানসার ও খাদ্যনালিতে ক্যানসারের মারাত্মক ঝুঁকি রয়েছে। এ ছাড়া কিডনি সমস্যা, ডায়াবেটিস, হাবা-গোবা, ঠোঁট কাটাসহ শরীরের যে কোনো অঙ্গে নানা জটিল রোগ হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, বিশ্বের সকল দেশে খাদ্যনিরাপত্তার বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। আর নিরাপদ খাদ্য খেলে শরীর ভালো থাকে। মেধার বিকাশ ঘটে এবং কাজ-কর্মে সক্ষমতা বাড়ে। তবে আমাদের দেশে খাবারের নামে বিষ খাচ্ছি। একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী অধিক মুনাফার লোভে এসব ক্ষতিকর ভারী ধাতু পোলট্রি খাদ্যে মেশাচ্ছে। পোলট্রি মুরগির খাবারে ভারী ধাতু মেশানো অমানবিক। তবে ভালোভাবে সিদ্ধ করে নিলে ক্ষতির দিকটা কমবে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, বিশ্বের সব দেশে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে আলাদা ব্যবস্থা থাকে। তারা নিয়মিত মনিটরিং করে সবকিছু। মানুষের জীবন রক্ষার্থে ভেজাল খাদ্য নিয়ন্ত্রণের জন্য আলাদা বিভাগ অতীব জরুরি।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. কাজী দ্বীন মোহাম্মদ বলেন, নিকেল, ক্রোমিয়াম, সিসা ও আর্সেনিক-এই চারটি ভারী ধাতু শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। স্নায়ুর ক্ষতি করে, স্মৃতিশক্তি কমতে থাকে।
জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. স্বপন কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, দেশে ক্যানসার রোগী বৃদ্ধির অন্যতম কারণ পোলট্রি মুরগির খাদ্যে ক্ষতিকর চারটি ভারী ধাতু। এ কারণে কোলন ক্যানসার, পাকস্থলী ক্যানসার ও খাদ্যনালিতে ক্যানসারের রোগী দেশে বাড়ছে। ক্যানসারসহ মরণব্যাধি বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হলো এসব ভেজাল খাদ্যসামগ্রী। এটা রোধ করতে হলে আলাদা ব্যবস্থা থাকতে হবে। আমেরিকার আদলে ফুল অ্যান্ড ড্রাগ প্রশাসন গড়ে তোলার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
বারডেম হাসপাতালের হরমোন ও ডায়াবেটিস বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. ফিরোজ আমিন বলেন, মানুষের শরীরে যে ইনসুলিন তৈরি হয়, সেই পক্রিয়ায় বাধা দেয় চার ভারী ধাতু। এতে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হন অনেকে। আবার অনেকের যৌন ক্ষমতা হারান।
প্রখ্যাত কিডনি বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ রেনাল অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. নিজাম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ভারী ধাতুর কারণে হঠাৎ কিডনি ফেইলর, ক্রোনিক কিডনি ডিজিসসহ কিডনিতে নানা সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। এই চারটি ধাতু কিডনির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। শ্রীলঙ্কাসহ বিভিন্ন দেশে গ্রামকে গ্রাম কিডনি সমস্যার দেখা দিয়েছে। পরে পরীক্ষা করে দেখা গেছে, খাদ্যে ভেজালের কারণে এই সমস্যা দেখা দিয়েছে। কিডনির জন্য মারাত্মক ঝুঁকি।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের এক গবেষণায় উঠে এসেছে, খাবার থেকে মুরগির শরীরে ঢুকছে এই ধাতু। ক্ষতিকর এই ধাতুর বিষয় না জেনেই প্রতিনিয়ত অসংখ্য মানুষ খাচ্ছে এই মুরগি। অতিমাত্রার এসব ভারী ধাতু মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। এ অবস্থায় অর্ধসিদ্ধ মুরগির মাংস না খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের অনার্স শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী তাশরিফ আহমেদ শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে ‘অ্যাসেসমেন্ট অব হেভি মেটালস ইন ব্রয়লার চিকেন অ্যান্ড ইটস সোর্স ট্র্যাকিং ইন খুলনা সিটি করপোরেশন এরিয়া’ শিরোনামে সম্প্রতি একটি গবেষণা করেন। ঐ গবেষণার জন্য তিনি নগরীর ময়লাপোতা সন্ধ্যা বাজার, রূপসা ঘাট, বয়রা বাজার, নিউ মার্কেট কাঁচা বাজার ও নিরালা বাজার থেকে ব্রয়লার মুরগি কিনে ল্যাবে নিয়ে যান। এরপর ল্যাবে ব্রয়লার মুরগির মাংস ও হাড় নিয়ে গবেষণা করেন। গবেষণাটির উদ্ধৃতি দিয়ে তাশরিফ আহমেদ জানান, ভারী ধাতু নিকেলের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদিত মাত্রা প্রতি কেজিতে শূন্য দশমিক ৫ মিলিগ্রাম। কিন্তু মাংসে পাওয়া গেছে ১২৮ মিলিগ্রাম ও হাড়ে ৭৯ মিলিগ্রাম। ক্রোমিয়ামের অনুমোদিত মাত্রা ১ মিলিগ্রাম হলেও পাওয়া গেছে মাংসে ১২ দশমিক ৫ মিলিগ্রাম ও হাড়ে ১০ দশমিক ৪৫ মিলিগ্রাম। সিসার অনুমোদিত মাত্রা ০ দশমিক ১ মিলিগ্রাম হলেও মাংসে পাওয়া গেছে ১৮ দশমিক ৫২ মিলিগ্রাম ও হাড়ে ৩ দশমিক ৭২ মিলিগ্রাম। আর্সেনিকের অনুমোদিত মাত্রা ০ দশমিক ১ মিলিগ্রাম হলেও মাংসে পাওয়া গেছে ০ দশমিক ৪৩ মিলিগ্রাম ও হাড়ে ০ দশমিক ৩৭ মিলিগ্রাম। ঐ শিক্ষার্থী বড়বাজার ও অন্য কয়েকটি স্থান থেকে ১৫টি কোম্পানির পোলট্রি ফিড (মুরগির খাবার) সংগ্রহ করে তা ল্যাবে পরীক্ষা করেন। তাতে দেখা যায়, প্রতি কেজিতে নিকেলের মাত্রা ১ দশমিক ৯৩ মিলিগ্রাম, ক্রোমিয়ামের মাত্রা ৬০ দশমিক ৫৮ মিলিগ্রাম এবং সীসার মাত্রা ৫ দশমিক ৮৬ মিলিগ্রাম।
তাশরিফ আহমেদ জানান, পোলট্রি ফিডে সিসার অনুমোদিত মাত্রা ০ দশমিক ০৫ মিলিগ্রাম। কিন্তু পাওয়া গেছে অনেক বেশি। নিকেল ও ক্রোমিয়ামের কোনো অনুমোদিত মাত্রা বের করেনি সংস্থাটি। আর তিনি আর্সেনিকের পরীক্ষাটি করতে পারেননি। তিনি জানান, পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন হোটেল-রেস্তোরাঁয় ব্রয়লার মুরগি দিয়ে তৈরি করা খাবারে কী পরিমাণ ভারী ধাতু রয়েছে তা নিয়ে গবেষণা করার পরিকল্পনা রয়েছে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিন প্রধান অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, মূলত ট্যানারি বর্জ্য দিয়ে তৈরি পোলট্রি ফিড বা খাবার খাওয়ানোর ফলে মুরগিতে অতিমাত্রার চারটি ধাতু ঢুকছে। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষর তদারকি করা প্রয়োজন।
এ ব্যাপারে খুলনার সিভিল সার্জন ডা. সুজাত আহমেদ বলেন, ব্রয়লার মুরগি যদি ভালোভাবে সিদ্ধ, ফ্রাই অথবা রান্না করে খাওয়া হয় তাহলে ঝুঁকি থাকে না। সেজন্য স্বাস্থ্য ঝুঁকি এড়াতে অর্ধসিদ্ধ মাংস না খাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
সূত্র: ইত্তেফাক