সোমবার, ০৮ ডিসেম্বর, ২০২৫, ২৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
আজকের দিনে # (হ্যাশট্যাগ) হলো সোশ্যাল মিডিয়ার প্রাণকেন্দ্র। ট্রেন্ডিং টপিক, আন্দোলনের স্লোগান এবং অনলাইন কমিউনিটির একটি অপরিহার্য অংশ। কিন্তু এই সহজ চিহ্নটির ইতিহাস প্রায় চার হাজার বছর পুরোনো এবং এর বিবর্তন সত্যিই চমকপ্রদ।
একটি প্রাচীন ওজনের প্রতীক কীভাবে আধুনিক ডিজিটাল যোগাযোগের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হয়ে উঠলো, সেই গল্পটি তুলে ধরা হলো।
১. জন্ম: প্রাচীন ওজন পরিমাপক প্রতীক
হ্যাশ চিহ্নের প্রথম অস্তিত্ব পাওয়া যায় অনেক পুরোনো পাণ্ডুলিপিতে, যেখানে এটি কোনো ইন্টারনেট সেনসেশন ছিল না, বরং ছিল একটি সরল প্রতীক।
রোমান যুগে 'লিব্রা পন্ডো' (lb): হ্যাশ চিহ্নের প্রাথমিক উৎস খুঁজে পাওয়া যায় ল্যাটিন শব্দগুচ্ছ Libra Pondo-তে, যার অর্থ 'ওজনের পাউন্ড'। পাউন্ড বোঝাতে সংক্ষেপে 'lb' লেখা হতো। এই 'lb' অক্ষর দুটিকে লেখার সময় দ্রুততা আনার জন্য একটির উপর আরেকটি লিখে ফেলা হতো, যা ধীরে ধীরে আজকের # চিহ্নের আকার নেয়।
যুক্তরাষ্ট্রে 'পাউন্ড সাইন': দীর্ঘকাল ধরে উত্তর আমেরিকায় এই চিহ্নটি ওজনের একক 'পাউন্ড' বোঝাতে ব্যবহৃত হতো, যেমন 10\text{ lbs} না লিখে লেখা হতো 10\#।
২. টেলিযোগাযোগের প্রবেশ: ডায়াল প্যাডের 'অক্টাথর্প'
এই প্রতীকটি দৈনন্দিন ব্যবহার থেকে হঠাৎ করেই প্রযুক্তির কেন্দ্রবিন্দুতে প্রবেশ করে ১৯৬০-এর দশকে।
অক্টাথর্পের আগমন: ১৯৬৮ সালে বেল ল্যাবস (Bell Labs) যখন টেলিফোন ডায়াল প্যাডে (কী-প্যাড) এটি যুক্ত করে, তখন প্রকৌশলীরা এর জন্য একটি নতুন নাম দেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করেন। তারা এই চিহ্নের আটটি প্রান্তকে বোঝাতে 'অক্টা' (আট) এবং একজন কর্মীর নাম থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে 'থর্প' শব্দটি জুড়ে দিয়ে এর নাম দেয় 'অক্টাথর্প' (Octothorpe)।
ফাংশনাল ব্যবহার: টেলিফোনে এটি সাধারণত বিশেষ ফাংশন (যেমন ভয়েস মেইল সেটিং বা স্বয়ংক্রিয় মেনু নেভিগেশন) অ্যাক্সেস করার জন্য ব্যবহৃত হতো। এটি তখনো পরিচিতি বা ট্যাগিং-এর জন্য ব্যবহৃত হতো না।
৩. প্রযুক্তির মাধ্যমে বিবর্তন: প্রোগ্রামিং ও আইআরসি
ডিজিটাল বিপ্লবের শুরুতে # চিহ্ন প্রোগ্রামিং এবং যোগাযোগ প্রোটোকলের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে ওঠে।
প্রোগ্রামিংয়ে কমেন্ট: অনেক প্রোগ্রামিং ভাষা এবং স্ক্রিপ্টে # চিহ্নটি একটি লাইনের শুরু নির্দেশ করে, যার অর্থ হলো, ওই লাইনটি একটি 'কমেন্ট' বা মন্তব্য, যা কোড হিসাবে চালানো হবে না। এটি প্রোগ্রামারদের কোড বোঝার জন্য নির্দেশ দিতে সাহায্য করত।
আইআরসি (IRC) চ্যানেলে ট্যাগিং: ১৯৯০-এর দশকে ইন্টারনেট রিলে চ্যাট (IRC) নামক টেক্সট মেসেজিং প্ল্যাটফর্মে এই চিহ্নটি ব্যবহার শুরু হয়। এখানে, # চিহ্নটি একটি নির্দিষ্ট আলোচনার বিষয় বা 'চ্যানেল'-কে চিহ্নিত করত। যেমন, #science বা #music। এটি ছিল আজকের হ্যাশট্যাগের ধারণার প্রথম আনুষ্ঠানিক সূচনা।
৪. সামাজিক মাধ্যমের উত্থান: ক্রিস মেসিনা ও টুইটার
হ্যাশট্যাগকে তার আধুনিক রূপ এবং বিশ্বব্যাপী খ্যাতি এনে দেয় সোশ্যাল মিডিয়া।
জন্মদাতা ক্রিস মেসিনা: ২০০৭ সালের আগস্ট মাসে ক্যালিফোর্নিয়ার এক প্রযুক্তিবিদ ক্রিস মেসিনা (Chris Messina) টুইটারে প্রথম # চিহ্নের মাধ্যমে ট্যাগিং-এর ধারণাটি প্রস্তাব করেন।
তিনি একটি টুইটে লেখেন: "How do you feel about using # (pound) for groups. As in #barcamp [?]"
টুইটারের গ্রহণ: প্রথমদিকে টুইটার এই ধারণাটি গ্রহণ করতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিল, কিন্তু ২০০৭ সালের সান দিয়েগোতে ভয়াবহ দাবানলের সময় স্থানীয় বাসিন্দারা দুর্যোগ সংক্রান্ত তথ্য সংগঠিত করার জন্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে #sanidiegofire ব্যবহার করা শুরু করলে এর কার্যকারিতা প্রমাণিত হয়। এরপর ২০০৯ সালে টুইটার আনুষ্ঠানিকভাবে হ্যাশট্যাগকে হাইপারলিঙ্ক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
৫. বর্তমান প্রভাব: একটি বৈশ্বিক ভাষা
টুইটার থেকে শুরু করে ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুক, টিকটক এবং ইউটিউবে হ্যাশট্যাগ এখন একটি শক্তিশালী সরঞ্জাম। এটি ট্রেন্ডিং টপিক তৈরি করে, বিশ্বব্যাপী আলাপচারিতাকে ঐক্যবদ্ধ করে। এটি তথ্য শ্রেণীবদ্ধ করে এবং ব্যবহারকারীদের তাদের আগ্রহের বিষয় খুঁজে পেতে সাহায্য করে। এটি #BlackLivesMatter বা #MeToo-এর মতো সামাজিক আন্দোলন ও গণজাগরণের প্রতীক হিসেবে কাজ করে।
চার হাজার বছর আগে 'পাউন্ড' বা ওজনের প্রতীক হিসেবে যার জন্ম, আর টেলিফোনের কী-প্যাডে 'অক্টাথর্প' হিসেবে যিনি পরিচিত ছিলেন, আজ সেই # চিহ্নই পরিণত হয়েছে ডিজিটাল সমাজের অন্যতম শক্তিশালী সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক উপকরণে। এটি আমাদের দেখায় যে কীভাবে একটি সরল প্রতীক প্রযুক্তির হাত ধরে বিবর্তিত হয়ে বিশ্বকে সংযুক্ত করার একটি নতুন ভাষা তৈরি করতে পারে।