সোমবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ৩১ ভাদ্র ১৪৩২
নগরজীবনের ব্যস্ততা আজ মানুষকে এমন বাস্তবতায় দাঁড় করিয়েছে, যেখানে চার দেয়ালের ফ্ল্যাটই জীবনযাপনের কেন্দ্র। ছোট ঘর, সীমিত স্থান, আর একইসঙ্গে স্বাস্থ্যবিধি ও ইবাদতের প্রয়োজনীয়তা মানুষকে নতুন সংকটে ফেলেছে।
অনেকে নামাজের সময় ঘনিয়ে এলে দ্বিধায় পড়ে যান—যদি আলাদা কোনো অজুখানা না থাকে, তবে কি বাথরুমেই ওজু করা যাবে? আর প্রয়োজনে সেখানে নামাজ আদায় করা সম্ভব কি না? শরিয়তের অবস্থান এ বিষয়ে কী?
ইসলামে পরিচ্ছন্নতা শুধু স্বাস্থ্যবিধির অংশ নয়, বরং ঈমানের অঙ্গ। রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, “পবিত্রতা ঈমানের অর্ধেক”। (সহিহ মুসলিম)
কুরআনে আল্লাহ ঘোষণা করেছেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ তাওবা গ্রহণকারীদের ভালোবাসেন এবং তিনি পরিচ্ছন্নতা ভালোবাসেন”। (সুরা বাকারা: ২২২)
ওজু তাই কেবল হাত-মুখ ধোয়া নয়, বরং এক আধ্যাত্মিক পরিচ্ছন্নতা। কিন্তু এই ইবাদত যদি নাপাকির জায়গায় সম্পন্ন হয়, তবে তার মর্যাদা প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
শরিয়তের সীমারেখা ও আধুনিক জীবনের বাস্তবতা
ফিকহবিদরা এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর মতে, বাথরুমে ওজু করা মূলত মাকরুহ। কারণ সেখানে নাপাকির আধিক্য থাকে এবং ওজুর সময় কুরআনের আয়াত বা দোয়া পড়া সুন্নত, যা নাপাকির স্থানে মুখে উচ্চারণ করা অনুচিত। তবে প্রয়োজনে সেখানে ওজু করলে তা বৈধ, শুধু মুখে নয়, মনে মনে নিয়ত ও দোয়া করতে হবে।
ইমাম শাফেয়ি (রহ.) ও ইমাম মালিক (রহ.) ভিন্ন দিক থেকে বলেছেন, ওজুর পানি পবিত্র এবং যদি তা নাপাকির সঙ্গে না মেশে তবে ওজু বৈধ থাকবে। সুতরাং বাথরুমে ওজু করা জায়েজ, তবে সতর্কতার সঙ্গে, আর আল্লাহর নাম মনে মনে উচ্চারণ করাই উত্তম।
সমসাময়িক ফতোয়া বোর্ডগুলোও একই অবস্থান নিয়েছে। ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দের ফতোয়া হলো—যদি টয়লেট ও ওজুর স্থান একত্র থাকে, তবে ওজু করা বৈধ, কিন্তু দোয়া জোরে পড়া যাবে না।
বাংলাদেশ ইসলামি ফিকহ বোর্ডও বলেছে—যদি আলাদা অজুখানা না থাকে, তবে বাথরুমে ওজু করা অনুমোদিত, যদিও এটি অপছন্দনীয়।
কিন্তু নামাজের ব্যাপারে শরিয়তের অবস্থান অনেক কঠোর ও স্পষ্ট। নাপাকির স্থানে নামাজ আদায় করা সর্বসম্মতভাবে হারাম।
চার ইমাম—আবু হানিফা, মালিক, শাফেয়ি ও আহমদ (রহ.)—সকলেই একমত যে টয়লেট বা নাপাকির স্থানে নামাজ আদায় করা বাতিল।
রাস্তা নির্মাণের জন্য মসজিদ ভাঙা যাবে?
সহিহ বুখারি ও মুসলিমে বর্ণিত হাদিসে রাসুল সা. ঘোষণা করেছেন, “পুরো পৃথিবী আমার জন্য পবিত্র ও মসজিদ বানানো হয়েছে, তবে কবরস্থান ও টয়লেট ছাড়া”। ফলে টয়লেটের ভেতরে নামাজ কখনোই বৈধ নয়।
তবে আধুনিক বাথরুম অনেক সময় দুই ভাগে বিভক্ত থাকে—এক পাশে টয়লেট, আরেক পাশে শাওয়ার বা অজুখানা। যদি সেই স্থান পরিষ্কার হয় এবং নাপাকির প্রভাব সেখানে না পৌঁছায়, তবে বাধ্য হলে সেখানে নামাজ আদায় করা যায়।
কিন্তু এটিকে অভ্যাসে পরিণত করা উচিত নয়, কারণ নামাজ একটি মর্যাদাপূর্ণ ইবাদত, আর মর্যাদাপূর্ণ ইবাদতের জন্য পবিত্র ও সম্মানজনক পরিবেশ বেছে নেওয়াই সুন্নত।
এখানে পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ওজু হলো পবিত্রতা অর্জনের উপায়, তাই শর্তসাপেক্ষে বাথরুমে তা বৈধ হতে পারে। কিন্তু নামাজ হলো আল্লাহর দরবারে দাঁড়ানো—এ মর্যাদাপূর্ণ ইবাদত নাপাকির স্থানে কখনোই বৈধ হয় না।
আজকের নগরায়িত জীবনে মানুষ বাধ্য হয়ে বাথরুমে ওজু করে, কারণ ফ্ল্যাটে আলাদা অজুখানা রাখা সম্ভব হয় না। শরিয়ত এ বাস্তবতাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে মুসলিম সমাজকে একইসঙ্গে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে, ঘরে একটি পরিচ্ছন্ন কোণা নির্ধারণ করো নামাজের জন্য, যেমন সাহাবারা করতেন।
কারণ ইবাদত শুধু রীতি নয়, এটি শ্রদ্ধা, মর্যাদা ও সম্মানের প্রতীক। সেই সম্মান রক্ষা করাই আমাদের ঈমানের দাবি।
ফলে শরিয়তের রায় একেবারে স্পষ্ট হয়ে দাঁড়ায়: বাথরুমে ওজু করা বৈধ, যদিও মাকরুহ, আর দোয়া মুখে না পড়ে মনে মনে পড়তে হবে। কিন্তু বাথরুম বা টয়লেটের ভেতরে নামাজ আদায় করা হারাম এবং বাতিল।
আধুনিক বাথরুমের আলাদা পরিষ্কার অংশে জরুরি অবস্থায় নামাজ পড়া যায়, তবে তা নিয়মিত হওয়া উচিত নয়। নামাজের আসল মর্যাদা কেবল তখনই রক্ষা পাবে, যখন তা হবে পবিত্র ও সম্মানজনক পরিবেশে, আল্লাহর সামনে দাঁড়ানোর উপযুক্ত ভঙ্গিতে।
লেখক: শিক্ষার্থী, আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, কায়রো, মিশর