শনিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ২৯ ভাদ্র ১৪৩২

স্বর্ণের একভরি গয়নার দাম এখন প্রায় ২ লাখ টাকার বেশি

জীবন যাপন সেপ্টেম্বর ১১, ২০২৫, ১০:২৪ এএম
স্বর্ণের একভরি গয়নার দাম এখন প্রায় ২ লাখ টাকার বেশি

চলতি সেপ্টেম্বর মাসে মাত্র ১০ দিনে স্বর্ণের দাম বেড়েছে ছয়বার। একভরি ২২ ক্যারেট স্বর্ণের মূল্য বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮৫ হাজার ৯৪৭ টাকায়, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।

সর্বশেষ একদিনের ব্যবধানে ২২ ক্যারেট স্বর্ণের দাম প্রতি ভরিতে ৩ হাজার ১৩৫ টাকা বেড়েছে। তবে এই দামের সঙ্গে ৫ শতাংশ ভ্যাট ও ৬ শতাংশ মজুরি যোগ হওয়ায় ক্রেতাদের জন্য একভরি গয়না কিনতে খরচ হচ্ছে প্রায় ২ লাখ টাকার বেশি।

আগামী বছর বা তার পরের সময়ে স্বর্ণের দাম প্রতিভরি দুই লাখ টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে ধারণা করছেন জুয়েলার্স ব্যবসায়ীরা।

চলতি বছর এখন পর্যন্ত ৫১ বার সোনার দাম সমন্বয় করা হয়েছে, যার মধ্যে ৩৫ বার দাম বেড়েছে এবং ১৬ বার কমেছে।

ব্যবসায়ীদের মতে, দামের লাগামহীন বৃদ্ধির কারণে নতুন গয়নার বিক্রি ৩০-৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। কোথাও কোথাও এই হার ৫০ শতাংশে পৌঁছেছে। আগে যেখানে দোকানগুলোতে নতুন গয়না বিক্রি ছিল ৭০ শতাংশ এবং পুরোনো গয়না ক্রয় ৩০ শতাংশ, এখন তার উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে।

বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দাম নতুন রেকর্ড গড়ছে। চলতি সপ্তাহে প্রতি আউন্স স্বর্ণের দাম ৩ হাজার ৬৪৭ ডলার ছাড়িয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, এ ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী বছরগুলোর মধ্যে দাম ৪ হাজার ডলার অতিক্রম করা সময়ের ব্যাপার, আর অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি হলে এক সময় অচিন্তনীয় ৫ হাজার ডলারের মাইলফলকও স্পর্শ করতে পারে।

আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাকস স্বর্ণকে বর্তমানে তাদের “সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বিনিয়োগ” হিসেবে উল্লেখ করেছে। প্রতিষ্ঠানটির পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ দাম পৌঁছাতে পারে ৩ হাজার ৭০০ ডলারে এবং ২০২৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে ৪ হাজার ডলারে। তাদের ধারণা, যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারিজে বেসরকারি বিনিয়োগের মাত্র ১ শতাংশ স্বর্ণে স্থানান্তরিত হলেও দাম ৫ হাজার ডলারের ঘরে পৌঁছে যেতে পারে।

স্বর্ণের দাম বারবার বাড়ার কারণ

 

বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে বিনিয়োগকারীরা নিরাপদ পণ্য হিসেবে স্বর্ণকে বেছে নিচ্ছেন। বিশেষত ইউক্রেন ও গাজায় যুদ্ধ, যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যনীতি, এবং বৈশ্বিক মুদ্রা অস্থিরতার কারণে দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে।

অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক কেসিএম ট্রেডের প্রধান বাজার বিশ্লেষক টিম ওয়াটারার মনে করেন, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার সময় বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবাজার বা বন্ডের তুলনায় স্বর্ণকেই সবচেয়ে নিরাপদ বিনিয়োগ মনে করেন। তিনি রয়টার্সকে বলেন, “স্বর্ণের দাম তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল হওয়ায় অনিশ্চয়তার সময় বিনিয়োগকারীরা এর দিকে বেশি ঝুঁকছেন। শেয়ারবাজারে হঠাৎ ওঠা-নামার ঝুঁকি এড়াতে স্বর্ণকে নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে দেখা হচ্ছে।”

যুক্তরাষ্ট্রে ফেডারেল রিজার্ভ সুদের হার কমানোর সম্ভাবনা, ডলারের দুর্বলতা, এবং মার্কিন শুল্কনীতির প্রভাবও স্বর্ণের দাম বাড়াচ্ছে। ডলার দুর্বল হলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা তুলনামূলকভাবে বেশি স্বর্ণ কিনতে সক্ষম হন।

বাংলাদেশে স্বর্ণের দাম ২০০০ সালে ২২ ক্যারেট একভরি ছিল মাত্র ৬,৯০০ টাকা। ২০১০ সালে তা দাঁড়ায় ৪২,১৬৫ টাকা, ২০২০ সালে প্রায় ৭০,০০০ টাকা এবং ২০২৩ সালে প্রথমবারের মতো এক লাখ টাকা অতিক্রম করে। চলতি বছরের শুরুতে দাম ছিল দেড় লাখ, এখন পৌঁছেছে ১,৮৫,৯৪৭ টাকায়। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, চলমান ধারা অব্যাহত থাকলে ২০২৬ সালের মধ্যে একভরির দাম দুই লাখ টাকা ছুঁতে পারে।

২০২৪ সালে দেশে মোট ৬২ বার স্বর্ণের দাম সমন্বয় করা হয়েছিল—যার মধ্যে ৩৫ বার দাম বেড়েছে, আর ২৭ বার কমেছে।

ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের ২০২৫ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের পর থেকে ডলারের হিসাবে প্রতিবছর গড়ে ৮ শতাংশ হারে বেড়েছে স্বর্ণের দাম। বর্তমানে বিশ্ববাজারে স্বর্ণের বার্ষিক চাহিদা দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৩৪ টন, যার মূল্য ২৩৩ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে প্রায় ৪০ শতাংশ, গহনার জন্য ৩৩ শতাংশ, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভে ২০ শতাংশ এবং প্রযুক্তি খাতে ৭ শতাংশ।

বিনিয়োগের ক্ষেত্রে স্বর্ণ এখনও সাধারণ মানুষের কাছে খুব জনপ্রিয় নয়। অনেকেই মনে করেন, দাম অযৌক্তিকভাবে বেড়ে যাচ্ছে। তবে বাজুস কর্মকর্তাদের মতে, আর্থিক জ্ঞানের অভাবও বড় কারণ।


অপরদিকে, স্বর্ণ উৎপাদন বাড়াতে হিমশিম খাচ্ছে খনিশিল্প। নতুন খনিজভাণ্ডার আবিষ্কার কম, আর বিদ্যমান খনির মানও নিম্নমুখী। ফলে বাজারে সরবরাহ সীমিত হচ্ছে, যা চাহিদার সঙ্গে মিলে দামের ঊর্ধ্বগতিকে আরও ত্বরান্বিত করছে।

ট্রাম্প যেভাবে স্বর্ণের দাম বাড়াচ্ছেন

 

এপ্রিল মাসে ট্রাম্প বিশ্বের বহু দেশের বিরুদ্ধে তার ‘লিবারেশন ডে’ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন। এতে বৈশ্বিক বাণিজ্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে বড় ধরনের অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। আর তখনই স্বর্ণের দাম হঠাৎ বেড়ে যায়।

এছাড়া সম্প্রতি ট্রাম্প মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভের স্বাধীনতার ওপর আক্রমণ বাড়িয়েছেন, যা দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতির ঊর্ধ্বে হিসেবে বিবেচিত হতো। এটিও দাম বাড়ানোর পেছনে ভূমিকা রেখেছে।

আবার ট্রাম্প বারবার কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সুদের হার কমাতে চাপ দিয়েছেন অর্থনীতি চাঙা করার উদ্দেশ্যে। তিনি ডলারের মানও কমাতে চান, যাতে মার্কিন রফতানি আরও প্রতিযোগিতামূলক হয়।

ক্যাপিটাল ডট কমের সিনিয়র আর্থিক বিশ্লেষক কাইল রডার মতে, এই দুই পরিস্থিতিই স্বর্ণকে বিনিয়োগকারীদের কাছে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে। আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম আলজাজিরাকে তিনি বলেছেন, যদি সুদের হার বাড়ে, তাহলে সোনা কম আকর্ষণীয় হয়। কারণ তখন ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মতো সুদযুক্ত সম্পদ থেকে বেশি আয় পাওয়া যায়। কিন্তু সুদের হার কমলে হাতে কম সুদ আসে, তখন সোনা ধরে রাখা তুলনামূলকভাবে বেশি লাভজনক হয়ে ওঠে।

Side banner